কুরবানী কি ইসলামে ফরজে এই সম্পর্কে বিস্তারিত জানুন
আপনারা হয়তো অনেকেই প্রতিদিন কুরবানী কি ইসলামে ফরজ এই সম্পর্কে অনেক খোঁজাখুঁজি করতেছেন। আজকে আর্টিকেলের মূল বিষয় হচ্ছে কুরবানী কি ইসলামে ফরজ সম্পর্কে। আপনারা যদি এ বিষয়ে ভালোভাবে জানতে চান তাহলে সম্পূর্ণ আর্টিকেলটি মনোযোগ সহকারে পড়তে হবে।
প্রিয় পাঠক বা গ্রাহক উপরোক্ত বিষয়টি ছাড়াও রয়েছে ইসলামে কুরবানীর ফজিলত কি? কুরবানী ফরজ হওয়ার শর্ত কী?, কুরবানী ওয়াজিব হওয়ার দলিল কী? ইত্যাদি বিষয়ে আপনাদের সামনে উপস্থাপন করা হয়েছে।
ভূমিকা
কুরবানি ইসলাম ধর্মের একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত যা মুসলিমদের জন্য আত্মত্যাগ, আনুগত্য ও আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের প্রতীক। আরবি শব্দ ‘কুরব’ অর্থ নিকটবর্তী হওয়া, আর কুরবানি শব্দটি এসেছে সেই মূল থেকে, যার মাধ্যমে একজন মুসলমান আল্লাহর সান্নিধ্য লাভের উদ্দেশ্যে নির্দিষ্ট পশু উৎসর্গ করেন। প্রতি বছর জিলহজ মাসের ১০ তারিখে ঈদুল আযহার দিন থেকে শুরু করে তিন দিনব্যাপী এই কুরবানি সম্পন্ন হয়।
কুরবানির সূচনা ঘটে হজরত ইব্রাহিম (আ.) ও তাঁর পুত্র হজরত ইসমাইল (আ.)-এর নিঃস্বার্থ আত্মত্যাগের ইতিহাস থেকে, যখন ইব্রাহিম (আ.) আল্লাহর নির্দেশে তাঁর প্রিয় পুত্রকে কুরবানি করতে প্রস্তুত হন। আল্লাহ তাঁর এই নিঃস্বার্থতা দেখে ইসমাইলের পরিবর্তে একটি পশু পাঠিয়ে দেন। এই ঐতিহাসিক ঘটনাকে স্মরণ করেই মুসলিমরা কুরবানি করে থাকেন।
কুরবানি শুধু পশু জবাই নয়; এটি মানুষের ভেতরের কুপ্রবৃত্তি, অহংকার ও স্বার্থপরতাকে ত্যাগ করার শিক্ষা দেয়। এই ইবাদতের মাধ্যমে মুসলমানরা পরস্পরের সঙ্গে সহানুভূতি ও সমবেদনা ভাগাভাগি করে, কারণ কুরবানির মাংস তিন ভাগ করে গরিব-দুঃখীর মাঝে বিলিয়ে দেওয়াই এর মূল চেতনা।
কুরবানী কি ইসলামে ফরজ?
ইসলামে কুরবানী একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত, তবে এটি সবার জন্য ফরজ নয়। অধিকাংশ ইসলামী চিন্তাবিদ ও ইমামদের মতে, কুরবানী হলো ‘ওয়াজিব’—যা ফরজের পরবর্তী স্তরের আবশ্যক ইবাদত। বিশেষ করে হানাফি মাজহাব অনুযায়ী, যারা সামর্থ্যবান (নিসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক) ও মুকিম (স্থানীয়ভাবে অবস্থানরত), তাদের জন্য কুরবানী করা ওয়াজিব। তবে অন্য মাজহাবগুলোতে কুরবানীকে সুন্নতে মুআক্কাদাহ বলা হয়েছে, অর্থাৎ এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ সুন্নাহ যা রাসুল (সা.) নিয়মিত পালন করেছেন এবং তা না করা অনুচিত।
পবিত্র কুরআনের সূরা কাওসারে আল্লাহ বলেন, “অতএব, তোমার প্রভুর জন্য নামাজ আদায় করো এবং কুরবানী করো।” (সূরা কাওসার: ২)। হাদীসেও রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, “যার সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও সে কুরবানী করলো না, সে যেন আমাদের ঈদগাহের নিকটেও না আসে।” (ইবনে মাজাহ)
এইসব দলিল প্রমাণ করে যে, সামর্থ্যবান মুসলিমদের জন্য কুরবানী একটি অত্যন্ত গুরুত্বের ইবাদত। এটি আল্লাহর প্রতি আনুগত্য ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশের মাধ্যম। তবে কুরবানীর ফরজ না হলেও তা অবহেলা করা উচিত নয়।
ইসলামে কুরবানীর ফজিলত কি?
কুরবানী ইসলামে একটি মহান ইবাদত, যার মাধ্যমে একজন মুসলমান আল্লাহর প্রতি আনুগত্য, ভালোবাসা ও আত্মত্যাগ প্রকাশ করে। কুরআন ও হাদীসে কুরবানীর বহু ফজিলত বর্ণিত হয়েছে। কুরআনে আল্লাহ বলেন, “আল্লাহর নিকট পশুর মাংস ও রক্ত পৌঁছায় না, বরং তোমাদের তাকওয়া পৌঁছে।” (সূরা হজ্জ: ৩৭)
হাদীসে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, “কেয়ামতের দিনে কুরবানীর পশু তার শিং, খুর ও পশমসহ নিয়ে আগমন করবে এবং নিশ্চয় কুরবানী আল্লাহর দরবারে এমন আগে কবুল হয় যে, রক্ত মাটিতে পড়ার আগেই তা আল্লাহর কাছে পৌঁছে যায়।” (তিরমিযী)
কুরবানীর মাধ্যমে গরিবদের সাহায্য, আত্মশুদ্ধি এবং সমাজে সহানুভূতির চর্চা হয়। এটি একজন মুমিনকে আত্মত্যাগের মহৎ শিক্ষাও প্রদান করে, যা আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের অন্যতম মাধ্যম।
পশু কোরবানি কি জায়েজ?
ইসলামে নির্দিষ্ট পশু কোরবানি করা সম্পূর্ণরূপে জায়েজ বা বৈধ এবং এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত হিসেবে স্বীকৃত। কোরবানি মূলত জিলহজ মাসের ১০ তারিখ ঈদুল আযহার দিনে শুরু হয়ে পরবর্তী দুই দিন, মোট তিন দিন পর্যন্ত আদায় করা যায়। এই সময়ে নির্দিষ্ট ধরনের পশু—গরু, ছাগল, ভেড়া, উট ইত্যাদি—কোরবানি করা ইসলামী শরীয়তের বিধান।
আল্লাহ তায়ালা কুরআনে বলেন, “তাদের (কোরবানিকৃত পশুদের) মাংস ও রক্ত আল্লাহর কাছে পৌঁছে না, বরং পৌঁছে তোমাদের তাকওয়া।” (সূরা হজ্জ: ৩৭)। এই আয়াত থেকে স্পষ্ট বোঝা যায়, পশু কোরবানি শুধুমাত্র মাংস বা রক্ত নয়, বরং এটি আত্মনিবেদন ও আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের প্রতীক।
হাদীসেও এসেছে, নবী করিম (সা.) নিজ হাতে কোরবানি করেছেন এবং সাহাবাদেরকেও তা আদায় করতে উৎসাহিত করেছেন। তাই সুস্থ ও নির্দিষ্ট বয়সের পশু কোরবানি করা ইসলামে সম্পূর্ণ জায়েজ ও পুরস্কারপ্রাপ্ত কাজ।
তবে পশুর প্রতি নিষ্ঠুরতা, কষ্ট বা নির্দিষ্ট নিয়ম লঙ্ঘন করা জায়েজ নয়। কোরবানি অবশ্যই ইসলামী বিধান মেনে, দয়া ও সহানুভূতির সঙ্গে সম্পন্ন করতে হবে।
মৃত ব্যক্তির জন্য কুরবানী দেওয়া যাবে কি?
ইসলামী শরীয়তে মৃত ব্যক্তির জন্য কুরবানী দেওয়া জায়েজ এবং এটি একটি সওয়াবের কাজ হিসেবে গণ্য হয়। কেউ যদি নিজের পক্ষ থেকে কুরবানীর পাশাপাশি মৃত বাবা-মা বা প্রিয়জনের নামে আলাদাভাবে কুরবানী করে, তবে তা আল্লাহর কাছে কবুল হওয়ার আশা করা যায়। রাসুলুল্লাহ (সা.) নিজেও কিছু সাহাবিদের মৃত আত্মীয়ের পক্ষ থেকে সদকা বা ইবাদত করার অনুমতি দিয়েছেন।
তবে এর জন্য শরীয়তের নির্ধারিত নিয়ম মেনে কুরবানী দিতে হবে, যেমন—পশু নির্বাচনে যোগ্যতা, সময়, এবং সঠিক নিয়ত থাকা জরুরি। অনেকে পরিবারিকভাবে একটি গরুতে একটি অংশ মৃত ব্যক্তির নামে উৎসর্গ করেন, এটিও জায়েজ।
মৃতদের নামে কুরবানীর মাধ্যমে তাঁদের আত্মার মাগফিরাত ও মর্যাদা বৃদ্ধির দোয়া করা হয়। এটি জীবিতদের জন্যও আল্লাহর নিকট এক নেক আমল হিসেবে বিবেচিত হয়।
মহান আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে কত ধরনের পশু কোরবানি করা যাবে?
মহান আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে ইসলামে কিছু নির্দিষ্ট প্রকারের পশু কোরবানি করা যায়। কোরআন ও হাদীসের আলোকে নিম্নোক্ত পশুগুলো কোরবানির জন্য জায়েজ:
কোরবানির উপযোগী পশুর ধরন (মোট ৫ প্রকার):
- উট
- গরু / ষাঁড় / মহিষ
- ছাগল
- ভেড়া
- দুম্বা
কিছু গুরুত্বপূর্ণ শর্ত:
বয়সের শর্ত:
- উট: কমপক্ষে ৫ বছর পূর্ণ।
- গরু/মহিষ: কমপক্ষে ২ বছর পূর্ণ।
ছাগল, ভেড়া, দুম্বা: কমপক্ষে ১ বছর পূর্ণ (তবে ৬ মাস বয়সী যদি দেখতে ১ বছরের মতো হয়, তবে ভেড়া/দুম্বা জায়েজ)।
শারীরিক শর্ত:
পশুটি সুস্থ, অঙ্গহীন নয়, এবং চোখ বা হাঁটুর সমস্যা নেই এমন হতে হবে।
অংশগ্রহণ:
উট ও গরুতে সর্বোচ্চ ৭ জন অংশ নিতে পারেন।
ছাগল, ভেড়া ও দুম্বা শুধুমাত্র ১ জনের পক্ষ থেকে কোরবানি করা যায়।
কুরবানী ফরজ হওয়ার শর্ত কী?
ইসলামে কুরবানী সরাসরি ফরজ না হলেও হানাফি মাজহাব অনুযায়ী এটি ওয়াজিব, অর্থাৎ ফরজের কাছাকাছি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। কুরবানী ওয়াজিব হওয়ার জন্য কিছু নির্দিষ্ট শর্ত পূরণ হওয়া জরুরি।
সেগুলো হলো:
মুসলমান হওয়া – কুরবানী শুধু মুসলমানদের ওপর প্রযোজ্য।
বালেগ (প্রাপ্তবয়স্ক) হওয়া – অপ্রাপ্তবয়স্কদের ওপর কুরবানী ওয়াজিব নয়।
আক্ল সম্পন্ন (সচেতন) হওয়া – পাগল বা মানসিক ভারসাম্যহীনদের ওপর কুরবানী ওয়াজিব নয়।
নিসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক হওয়া – যাদের কাছে ঈদুল আযহার দিনে প্রয়োজনের অতিরিক্ত নির্দিষ্ট পরিমাণ সম্পদ (প্রায় ৭.৫ তোলা সোনা বা সমমূল্যের সম্পদ) থাকে, তাদের ওপর কুরবানী ওয়াজিব হয়।
মুকীম (স্থানীয়) হওয়া – মুসাফির (অস্থায়ী ভ্রমণকারী) ব্যক্তির ওপর কুরবানী ওয়াজিব নয়।
এই শর্তগুলো পূরণ হলেই কুরবানী করা একজন মুসলমানের জন্য আবশ্যক হয়ে যায়।
কত টাকা হলে কোরবানি ফরজ হয়?
কোরবানি ফরজ না হলেও হানাফি মাজহাব অনুযায়ী এটি ওয়াজিব, এবং তা নির্দিষ্ট পরিমাণ সম্পদের মালিকদের ওপর আবশ্যক। যে ব্যক্তির কাছে ঈদুল আযহার দিন সুবেহ সাদিক থেকে শুরু করে ঈদের তৃতীয় দিন সূর্যাস্ত পর্যন্ত সময়ে নিত্যপ্রয়োজনীয় খরচ বাদে নিসাব পরিমাণ সম্পদ থাকে, তার ওপর কোরবানি ওয়াজিব হয়।
নিসাবের পরিমাণ হলো:
- সোনা: প্রায় ৭.৫ তোলা (৬১.২৫ গ্রাম)
- রুপা: প্রায় ৫২.৫ তোলা (৫১২.৫ গ্রাম)
অথবা এই পরিমাণ মূল্যের নগদ টাকা, বাণিজ্যিক পণ্য বা জমা সম্পদ।
বর্তমান বাজারদর অনুযায়ী (যেমন ধরুন ২০২৫ সালে), যদি কারো কাছে প্রায় ৮৫,০০০ থেকে ৯৫,০০০ টাকা সমপরিমাণ সম্পদ থাকে, তাহলে তার ওপর কোরবানি ওয়াজিব হয়ে যায়। তবে এই পরিমাণ সময় ও সোনার রেট অনুযায়ী পরিবর্তন হতে পারে, তাই প্রতি বছর হালনাগাদ তথ্য জানা উচিত।
কুরবানী ওয়াজিব হওয়ার দলিল কী?
ইসলামী শরীয়তে কুরবানী একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত, যা হানাফি মাজহাব অনুযায়ী ওয়াজিব হিসেবে গণ্য হয়। কুরআন ও হাদীসে এর স্পষ্ট দলিল রয়েছে।
কুরআন শরীফে আল্লাহ তায়ালা বলেন:
“অতএব, তুমি তোমার প্রভুর জন্য নামাজ আদায় করো এবং কুরবানী করো।”
— (সূরা কাওসার: ২)
হাদীসে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন:
“যার কুরবানী করার সামর্থ্য আছে, অথচ সে কুরবানী করলো না, সে যেন আমাদের ঈদগাহে না আসে।”
— (ইবনে মাজাহ: ৩১২৩)
এই হাদীসটি কুরবানীর গুরুত্ব ও বাধ্যবাধকতা স্পষ্ট করে। ফকীহগণ এই দলিলের ভিত্তিতে বলেন, সামর্থ্যবান ব্যক্তির জন্য কুরবানী করা ওয়াজিব। এটি ইচ্ছামতো ছেড়ে দেওয়ার বিষয় নয় বরং একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত, যা পালন না করলে গুনাহগার হওয়ার আশঙ্কা থাকে।
পরিশেষে বলা যায় যে,কুরবানি ইসলামে একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত, যা আমাদের আল্লাহর প্রতি আনুগত্য, আত্মত্যাগ ও তাকওয়ার শিক্ষা দেয়। এটি কেবল পশু জবাই নয়, বরং একজন মুমিনের হৃদয়ের খাঁটি ইচ্ছা ও আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের প্রচেষ্টা। হানাফি মাজহাব অনুযায়ী, কুরবানি সামর্থ্যবান মুসলমানদের জন্য ওয়াজিব, এবং কুরআন ও হাদীস থেকে এর শক্ত দলিল রয়েছে। নির্দিষ্ট পরিমাণ সম্পদের মালিক হলে, অর্থাৎ নিসাব পরিমাণ অর্থ বা সম্পদ থাকলে, কুরবানি ওয়াজিব হয়।
মৃত ব্যক্তির পক্ষ থেকেও কুরবানি করা জায়েজ, যা তাদের জন্য সওয়াবের কাজ। কুরবানি করার পশুগুলো নির্দিষ্ট, এবং তা সুস্থ ও নির্ধারিত বয়সের হতে হবে। এসব বিষয় আমাদের শিক্ষা দেয় যে, কুরবানি কেবল একটি প্রথা নয়, বরং একটি গভীর আধ্যাত্মিক অনুশীলন, যা আত্মশুদ্ধি ও মানবিকতা বৃদ্ধির অন্যতম মাধ্যম। তাই এই ইবাদত যথাযথভাবে পালন করা প্রতিটি মুসলমানের উচিত। আপনার যদি আর্টিকেলটি পড়ে ভালো লাগে তাহলে একটি কমেন্ট বা শেয়ার করে যাবেন।
অর্ডিনারি আইটির নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url